Select Page

অঞ্জনের ‘মেঘমল্লার’ আর ইলিয়াসের ‘রেইনকোট’

অঞ্জনের ‘মেঘমল্লার’ আর ইলিয়াসের ‘রেইনকোট’

Untitled-1

মেঘমল্লার’ দেখলাম। প্রথমেই নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘রেইনকোট’ এর টেক্সট মাথায় রেখে এই সিনেমা দেখতে না যাওয়া উচিৎ। অর্থাৎ সিনেমাকে বইয়ের মতো না পড়ে সিনেমা হিসেবে দেখে নিতে চাই এবং অতি অবশ্যই সেই কাসুন্দিময় পুরনো তর্ক যা আমাদের এখানে এখনো ‘তর্ক’ আকারে হাজির হয় যে ফিল্ম মেকারের দায় আছে কি নাই, কোনো গল্প বা উপন্যাস থেকে ফিল্ম বানালে সেই সিনেমা সেই গল্প বা উপন্যাস এর মতো রাখতে হবে। একই সাথে আরেকটি বিষয়ও মাথায় রেখে নিতে চাই যে, ‘মেঘমল্লার’ জাহিদুর রহিম অঞ্জনের সিনেমা। এই সিনেমা দেখে যেন না বলে ফেলি যে ইলিয়াসের ‘রেইনকোট’ দেখে ফেললাম! কেননা প্রতিটি শিল্প তার জন্মদাত্রী শিল্পীর নির্মাণ। শিল্পীর কাজ তার ব্যক্তিগততা, বিশ্বাস, রাজনীতি ইত্যাদির গভীর ছাপ বহন করে।

যেহেতু এই দায় সংক্রান্ত তর্কের কার্যকারিতা নাই বলে বিশ্বাস করি তাই প্রথমেই তা বাদ দিতে চাই। জাহিদুর রহিম অঞ্জনের সিনেমা ‘মেঘমল্লার’ তাই তার সিনেমা আকারেই দেখতে চেয়েছি। এ কারণেই ইলিয়াসের রেইনকোটের সাথে অঞ্জনদার সিনেমার কোন তুলনামূলক আলোচনা তুলব না।

মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা মাত্রই যুদ্ধ, গোলাগুলি আর ধর্ষণ দেখাতে হবে এই ধারণা ভেঙ্গে বের হয়ে গেছে ‘মেঘমল্লার’।

মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা মাত্রই যুদ্ধ, গোলাগুলি আর ধর্ষণ দেখাতে হবে এই ধারণা ভেঙ্গে বের হয়ে গেছে ‘মেঘমল্লার’। এটা আমাদের সিনেমায় ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ধারণা বদলাতে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ দাগ। মুক্তিযুদ্ধ কেবল যুদ্ধ তো নয়, একটি জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন পাল্টে দেয়ার ঘটনা। মানবিক সম্পর্ক আর অসংখ্য খুঁটিনাটি দৈনন্দিন আচরণে গভীর আঁচড় কেটে দেয়ার সম্ভাবনা। আর সেই সম্ভাবনাই হাজির হয়েছে কলেজ শিক্ষক নুরুল হুদা পাক বাহিনীর ক্যাম্প থেকে ফিরে না আসার পরও তার স্ত্রী আসমার বেশ নির্লিপ্ত আচরণের মধ্য দিয়ে। প্রথমে কিছুটা ধাক্কা খেলেও পরে বুঝে নেয়া যায়, আসমার এই নির্লিপ্ততা পরিস্থিতির কারণে তাকে অর্জন করতে হয়েছে। যার জন্য আসমার ভাই যখন মুক্তিযুদ্ধে যায় তখনও আসমা তাকে বাঁধা দেয় নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে, কিন্তু মোটেও চোখের জল ফেলে নয়। এটাও বাংলাদেশের সিনেমায় একটা নতুন ঘটনা বলা যায় যে, একজন নারী দুর্বল চরিত্র নয় বরং তার রাজনৈতিক সুবিধাজনক অবস্থান নিয়ে শক্ত অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে আছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মধ্যবিত্ত মেয়েদের যাত্রা তখন বেশ জোরেশোরে শুরু হয়েছে। ফলে ‘চিরায়ত নরম মাতৃরূপী বাঙালী নারী’র ইমেজ সমাজে যেভাবে ভেঙ্গে গেছে, সেটা নির্মাতা তার সিনেমাতেও ভেঙ্গে ফেলছেন। সিনেমার শেষে এসে যখন আসমা তাদের সরকারি কোয়ার্টার ছেড়ে চলে যায়, তখন তার ভাইকে শুধু বলে, তার যেতে ইচ্ছে না করার কথা। আরও আরও কিছু শোনার ইচ্ছা থাকলেও নির্মাতা শোনান না, ছেড়ে দেন দর্শকের ওপর বাকি চিন্তার জায়গাটা।

মধ্যবিত্ত আমি নুরুল হুদা, মধ্যবিত্ত তুমিও নুরুল হুদা। সবাই এক একজন ব্যক্তি এবং পরস্পরের থেকে আলাদা। আলাদাভাবে সৎ এবং ভালো মানুষ, আলাদাভাবে ঝামেলামুক্ত থেকে ভালো থাকার প্রচেষ্টা এবং শেষ পর্যন্ত এই আলাদা ভালো মানুষ বা ভালো থাকার প্রচেষ্টা কি আরও বেশি নিঃস্ব এবং বিপদগ্রস্ত করে তোলে? এই অনুভূতিটাই কি এই সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নয়? সিনেমা দেখতে দেখতে আমার মধ্যে এই অনুভূতিই তো আসা যাওয়া করছিল। আর সেজন্যই প্রথমেই বলেছি জাহিদুর রহিম অঞ্জনের ‘মেঘমল্লার’ আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘রেইনকোট’ পৃথক সৃষ্টিকর্ম।

তাই যে রেইনকোট ইলিয়াসের নুরুল হুদার ভেতর অন্য এক ‘আমি’কে আবিষ্কার করায়, অঞ্জনদার নুরুল হুদার কাছে সেই রেইনকোটটা একটা পোশাকই, যা তাকে শুধু বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচায়। বরং আর্মি অফিসার দ্বারা সেই বর্ষাতির মাথার ঢাকনা তার নিঃশ্বাস বন্ধ করিয়ে দেয়। যে নুরুল হুদা পাক আর্মির অত্যাচারের এক পর্যায়ে আবিষ্কার করে ফেলে তার স্ত্রীর ছোট ভাইয়ের কথা ‘যুদ্ধে না গেলেও মরবা’ কত সত্য ছিল! এবং এ কারণেই অজানা সত্যকে, মিথ্যা করে বলা ছাড়া তার আর উপায় থাকে না। এই সময়ে, ২০১৪ সালে এসেও কি এই কথা একই রকম সত্য না?

জাহিদুর রহিম অঞ্জনের ‘মেঘমল্লার’ আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘রেইনকোট’ পৃথক সৃষ্টিকর্ম।

 

আমি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা ‘গেরিলা’তে কাজ করার সুবাদে এতটুকু বুঝতে পারছিলাম, বাংলাদেশের এ সময়ে ভিজ্যুয়ালি মুক্তিযুদ্ধের সময়কে ধরা খুব কঠিন। সবকিছু বদলে গেছে, যেখানে ফ্রেম ধরবেন সেখানেই বর্তমান সময়ের কোন না কোন চিহ্ন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে! তারপরও সচেতনভাবে একাত্তরের সময়টাকে ধরার চেষ্টা হয়েছে।

পরিচালনার সাথে সিনেমাটোগ্রাফি, সাউন্ড, মিউজিক সবকিছুই পুরো সিনেমায় পরস্পরের হাতে হাত ধরে এগিয়েছে। আলাদা করে কাউকে চোখে পড়েনি, আলাদা করে কারও কাজের বাড়াবাড়ি লাগেনি। সব জায়গাজুড়ে গুছানো পরিকল্পনার প্রকাশ পাওয়া গেছে। আর একটা সিনেমা তো এমনই হয়ে ওঠার কথা যেখানে যৌথতা মিলেমিশে কাজ করে। কেউ কাউকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় থাকে না বরং পরস্পরের মাঝে একাকার হতে চায়।

সিনেমাকর্মী হিসেবে মনে হয়েছে, এই সিনেমার শুটিংয়ে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বৃষ্টির দীর্ঘ দীর্ঘ দৃশ্যের দৃশ্যায়ন! খুবই সুচারুরূপে এই দৃশ্যায়ন যে কত কঠিন সাধনার ফসল তা যারা কাজ করেছেন সিনেমাটিতে তারাই কেবল বলতে পারবেন!

‘মেঘমল্লার’ এর সাফল্য কামনা করি, বাংলাদেশে নতুন সিনেমার যাত্রা সফল হোক!

[লেখাটি দ্য রিপোর্ট২৪.কমে পূর্ব প্রকাশিত]


মন্তব্য করুন