Select Page

‘দাঙ্গা’ শুধুই একটি চলচ্চিত্র নয়, নির্মম এক সত্যর উপলব্ধি

‘দাঙ্গা’ শুধুই একটি চলচ্চিত্র নয়, নির্মম এক সত্যর উপলব্ধি

হে মাতৃভূমি
কি দিলে প্রতিদান
মাগো তোমার জন্য
মোরা রক্ত দিলাম
৩০ লক্ষ তাজা প্রান

এমন একটি গানের জন্য ১৯৯১ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত শিল্পী (নারী) শাখায় পুরস্কার পেয়েছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন। যে গানটি ছিল ছবিতে যে চলচ্চিত্রের পোস্টার দেখছেন সেই ‘দাঙ্গা’ ছবির টাইটেল গান। যে গানটি শুনে কিশোর মনের রক্ত টগবগ করে উঠছিল। সেদিন শুধু আমি নই সিনেমাহলের ভেতর থাকা কয়েকশো দর্শকের রক্ত টগবগ করে উঠেছিল কাজী হায়াতের ‘দাঙ্গা’ নামের এই আগুনঝরা ছবিটি দেখে। পুরো ছবিটা যেন শিরোনাম সঙ্গীতের উল্লেখিত কথাগুলো বারবার প্রমান করে দিচ্ছিল, পুরো ছবিটা যেন বারবার সেই একই কঠিন প্রশ্নের সামনে আমাদের দাড় করিয়েছিল যা এককথায় অসাধারন। ‘দাঙ্গা’ শুধুই একটি বাণিজ্যিক বিনোদনধর্মী ছবির নাম নয়, ’দাঙ্গা’ হলো আমাদের নষ্ট সমাজ ও রাজনীতির নির্মম সত্যর চিত্রায়ন যা সেলুলয়েডের ফিতায় সাহসিকতার সাথে বাংলা চলচ্চিত্রের গুণী নির্মাতা কাজী হায়াত তুলে ধরেছিলেন। আজো ২৪ বছর আগের প্রেক্ষাপটটি এতটুকুও বদলায়নি বরং নষ্ট রাজনীতি আরও প্রকট আকারে আজ দেখা দিয়েছে। ২৪ বছর পরেও এই সমাজ, এই রাষ্ট্র আমাকে ‘দাঙ্গা’ ছবির গল্পটি বারবার মনে করিয়ে দেয়।

Dangaa

‘দাঙ্গা’র কাহিনী সংক্ষেপ – বাংলাদেশের ছোট একটি একটি থানার নাম ‘বেগুনবাড়ী’। ছোটখাটো একটা মফস্বল শহর বলতে পারেন। বেগুনবাড়ী এলাকার সংসদ সদস্য আবুল হোসেন যিনি সরকারী দলের একজন নেতাও। অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছেন মন্ত্রী হবার জন্য। বেগুনবাড়ী উপজেলার স্থানীয় চেয়ারম্যানও সংসদ সদস্য আবুল হোসেনের লোক যিনি এলাকায় প্রভাব ও শক্তি ধরে রাখার জন্য সংসদ সদস্যর নির্দেশে সকল কুকর্ম করে থাকেন। সরকার থেকে পাওয়া ত্রাণ সামগ্রী আবুল হোসেনের নির্দেশে লুটপাট করার জন্য নির্দিষ্ট গুদামে রাখা হয়। দিনের বেলায় যেখানে লোকদেখানো সামান্য ত্রাণ সামগ্রী বণ্টন করা হয় বাকীগুলো আত্মসাৎ করা হয়।

নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছবি একদিন অভাবের তাড়নায় একদিন ত্রাণসামগ্রী আনতে গেলে চেয়ারম্যানের লোলুপ দৃষ্টি পরে যেখান থেকে স্থানীয় কলেজের ভিপি ছাত্রনেতা হাবীব উদ্ধার করে এবং গুদামে রাখা গরীব মানুষদের ত্রাণসামগ্রী এলাকার সাধারন মানুষদের সহায়তায় লুটপাট করে নিয়ে যায় অর্থাৎ আত্মসাৎকৃত সরকারী ত্রাণগুলো এলাকার দুস্থ মানুষদের নিয়ে যাওয়ার জন্য সুযোগ করে দেয়। এতে হাবীবের উপর ক্ষিপ্ত হোন সংসদ সদস্য আবুল হোসেন যিনি নির্বাচনের সময় বিরোধিতার জন্য হাবিবের উপর আগে থেকেই ক্ষিপ্ত ছিলেন। আবুল হোসেন তাঁর স্থানীয় সহযোগী চেয়ারম্যান সাহেবকে আদেশ করেন হাবীবকে খুন করার জন্য। সংসদ সদস্যর কথামতো স্থানীয় চেয়ারম্যান সন্ত্রাসী, ভাড়াটে খুনি দুর্ধর্ষ কালুকে হাবীব হত্যার জন্য ভাড়া করে। কালু রাতের আঁধারে হাবীব’কে হত্যা করে কিন্তু হত্যা করার সময় বৃদ্ধ নাপিত অমূল্য প্রামানিক দেখে ফেলে যাকে কালু কাউকে কিছু দেখেছি বললে দুটি চোখ ও জিহবা কেটে ফেলে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ছেড়ে দেয়।

বেগুনবাড়ি এলাকায় রাজু নামের নতুন একজন ওসি বদলি হয়ে আসে যিনি হাবীব হত্যার তদন্তে নামেন। নতুন ওসি এসেই দেখতে পান থানার সব সকল পর্যায়ের পুলিশ সদস্য ঘোষখোর, দুর্নীতিবাজ যিনি সবাইকে সৎ ভাবে দায়িত্ব পালন করার জন্য সতর্ক করে দেন। হাবীব হত্যার তদন্ত ও অসহায় নিম্নবিত্ত তরুণী ছবির পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর কারণে ওসি রাজুর সাথে সংসদ সদস্য আবুল হোসেন , খুনি কালু ও স্থানীয় চেয়ারম্যানের বিরোধ দেখা দেয় যা চরম আকার ধারন করে। ওসির সাহসিকতা ও সহযোগিতার কারণে হাবীব হত্যার একমাত্র আসামী সংখ্যালঘু , নিরিহ, ভীত অমূল্য প্রামানিক সব সাক্ষ্য দিয়ে দেয়। সাক্ষ্য দেয়ার কারণে খুনি কালু তাঁর কথামতো অমূল্য প্রামানিকের দুটি চোখ তুলে নিয়ে অন্ধ ও জিহবা কেটে বোবা করে দেয়। অন্ধ ও বোবা অমূল্য প্রামাণিককে ওসি তাঁর বাড়ীতে আশ্রয় দেয় ।খুনি কালু ওসির গর্ভবতী স্ত্রী ছবিকে হত্যা খুন করে চলে যাওয়ার সময় ওসি’র গুলিতে খুন হয়। এরই মাঝে সন্ত্রাসিদের গডফাদার,দুর্নীতিবাজ সংসদ সদস্য পদোন্নতি লাভ করে মন্ত্রী হয়। এলাকায় সম্বর্ধনা আয়োজন করা হয় যেখানে ওসি রাজু আবুল হোসেন’কে গুলি করে হত্যা করে বাংলাদেশ থেকে একজন গডফাদার ও তাঁর সহযোগীদের নির্মূল করে মৃত্যুবরণ করে যেন ছবির শিরোনাম সঙ্গীতটি সার্থকতা প্রমান করে। সবার কাছে যেন নির্মম সত্য সেই প্রশ্নই ঘুরে ফিরে দেখা দেয় ” হে মাতৃভূমি / কি দিলে প্রতিদান / মাগো তোমার জন্য মোরা রক্ত দিলাম / ৩০ লক্ষ তাজা প্রান ‘’……… ৩০ লক্ষ শহীদদের আসলে কিছুই দেয়নি এই মাতৃভূমি।।

এই ছবির ভাড়াটে খুনি কালু’র চরিত্রে অভিনয় করে জীবনের প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছিলেন প্রয়াত অভিনেতা ওয়াসিমুল বারী রাজীব। ছবিতে রাজীবের বলা সংলাপ ‘আমি মাইন্ড করলাম, আমি খুব মাইন্ড করলাম’ ছিল সেইসময় খুব জনপ্রিয় একটি সংলাপ। খুনি কালু চরিত্রে ভয়ংকর অভিনয় করেছিলেন রাজীব যা দর্শক কোনদিন ভুলে যাবে না। সাহসী তরুন ওসি’র চরিত্রে চিত্রনায়ক মান্না অসাধারন অভিনয় করেছেন। উল্লেখ্য যে দ্বিতীয় নায়ক থেকে প্রথম নায়ক হওয়ার ধাপে মান্না’র ক্যারিয়ারে ‘দাঙ্গা’ ছবিটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। মিজু আহমেদ, সুচরিতা সহ ছবির প্রতিটি চরিত্র দারুন অভিনয় করেছে। সবগুলো চরিত্রকে মনে হয়ে বাস্তব চলমান কোন ঘটনার জীবন্ত চাক্ষুস সাক্ষী।

আজ থেকে ২৪ বছর আগের ছবির গল্পটি আজ ২৪ বছর পরেও যেন কত জীবন্ত হয়ে দেখা দিয়েছে। আজকের বর্তমান বাংলাদেশের অস্থির এক চিত্র যেন সেদিনের সেই ‘দাঙ্গা’ ছবির গল্পটি। সরকার বিরোধী ছাত্রনেতা হাবীব সরকারী দলীয় সংসদ সদস্যর হুকুমে খুন হওয়া, খুনি কালুর ভয়ে সত্য কথা বলার সাহস হারিয়ে ফেলা অমূল্য প্রামাণিক, নিম্নবিত্ত অসহায় তরুণী ছবি ও তাঁর মা, দুর্নীতিবাজ পুলিশ প্রশাসনের মাঝে নীতিবান, সৎ তরুন পুলিশ অফিসার রাজু সব যেন আজ সমাজের নিয়মিত এক একটি চরিত্র। খুনি ,সন্ত্রাসী কালু যার বিরুদ্ধে জীবন হারানোর ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারেনা সেই কালু’র রুপে যেন দেখা দিয়েছে আজকের বর্তমান রাষ্ট্রশক্তি। কালুর রুপে মানুষের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার কাজটি আজ রাষ্ট্র নিজেই করছে। আমরা যেন আজ সবাই জিহবা কেটে নেয়া ও দুচোখ উপড়ে ফেলা অন্ধ ও বোবা আশিস কুমার লৌহ। যার ফলে সরকারের রোষানলে না পরার জন্য সকলেই আজ অমূল্য প্রামানিকের মতো ভীত হয়ে সব দেখেও না দেখার ভান করে আছে । সংসদ সদস্য আবুল হোসেন, সহযোগী স্থানীয় চেয়ারম্যান ও সন্ত্রাসী কালু যেন আজ পুরো রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে দেখা দিয়েছে। যারা চায় সবাই যেন অন্ধ ও বোবা হয়ে থাকুক। যারা বিরোধী প্রতিবাদী কণ্ঠকে নিষ্ঠুর, নির্মমভাবে দমন করে। যারা প্রতিবাদী কণ্ঠকে নিস্তব্দ করার জন্য হত্যার উৎসবে মেতেছে। যাদের সীমাহীন অপকর্ম দেখেও প্রতিবাদ করার সাহস পায়না বাংলাদেশের জনগণ যা ঐ ‘দাঙ্গা’ ছবির গল্পে তুলে ধরা হয়েছে ছোট্ট একটি এলাকা বেগুনবাড়ি দিয়ে। দাঙ্গা ছবির সেই বেগুনবাড়ি থানা যেন আজ পুরো বাংলাদেশ হয়ে দেখা দিয়েছে। ছবির প্রতিটা দৃশ্য আজ পর্দায় নয় বাস্তবে দেখছি আজকের বর্তমান বাংলাদেশে । আমি ১০০% নিশ্চিত আজ যদি কেউ ‘দাঙ্গা’ ছবিকে নতুন করে নির্মাণ করতে চায় তাহলে তিনি বাধাগ্রস্থ হবেন। কারণ এই ছবির গল্পটি আজ এতোই প্রকট যে শোষকশ্রেণী তা নির্মাণ করতে দিবে না। আমি আমাদের নতুন পরিচালক, প্রযোজক, কাহিনীকারদের অনুরোধ করবো আপনারা বিদেশি ছবির গল্প অনুকরণ না করে আমাদের দেশের পুরনো চলচ্চিত্রগুলো থেকে অনেক দারুন কিছু গল্প অনুকরণ করুন। নিজের দেশের গুণী মানুষদের কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করুন। কাজী হায়াতের ‘দাঙ্গা’ যেন ২৪ বছর আগের আজকের বর্তমান বাংলদেশের দূরদর্শী চিত্রায়ন। স্যালুট কাজী হায়াতকে

পোস্টার কৃতজ্ঞতা: আমি বাংলা চলচ্চিত্রের পোস্টারের কথা উঠলেই যে কয়েকটি ছবির পোস্টার দেখার ইচ্ছে করি ‘’দাঙ্গা’ ছবির এই পোস্টারটিও তার অন্যতম । সবকিছু হারিয়ে যাওয়ার এই যুগে খুব প্রিয় এই ছবিটির পোস্টার আবার দেখতে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম । ইউটিউবে পরিচিত হওয়া বন্ধু অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কাজল রিপন ভাই আমার সেই অসাধ্য ইচ্ছেটি পূরণ করেছেন যার কারণে কাজল রিপন ভাইয়ের কাছে চিরঋণী হয়ে থাকলাম । কাজল রিপন ভাইকে অনেক অনেক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

কবি ও কাব্য

আমি ফজলে এলাহী পাপ্পু, কবি ও কাব্য নামে লিখি। স্বর্ণযুগের বাংলাদেশী চলচ্চিত্র এবং বাংলা গানকে এ যুগের সকলের কাছে পৌছে দেয়ার আগ্রহে লিখি।

মন্তব্য করুন