Select Page

বক্স অফিস কাঁপানো ‘আসামী হাজির’-এর নেপথ্য গল্প

বক্স অফিস কাঁপানো ‘আসামী হাজির’-এর নেপথ্য গল্প


দেওয়ান নজরুল নামের আমাদের মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির একজন পরিচালক ছিলেন যাকে ‘ডায়নামিক ডিরেক্টর’ বলা হতো, যার পরিচালিত বক্সঅফিস কাঁপানো বেশকিছু চলচ্চিত্র ছিল। কেন দেওয়ান নজরুল’কে ‘ডায়নামিক ডিরেক্টর’ বলা হতো সেই কারণটা আজ আপনাদের বলবো। প্রথমেই পত্রিকার একটি বিজ্ঞাপনের অংশ দেখিয়ে ‘আসামী হাজির’ নামের বাংলাদেশের সর্বপ্রথম ওয়েস্টার্ন প্যাটার্নের ছবির সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। তারপর আপনাদের সেই ছবি সম্পর্কে বিস্তারিত বলবো। জেনে নিন মান্ধাতার আমলে কি পরিমাণ শ্রম, মেধা ও আন্তরিকতা দিয়ে বাংলাদেশের সাধারন দর্শকদের হলিউদের ওয়েস্টার্ন প্যাটার্নের ছবি আমাদের গুনি মানুষগুলো উপহার দিয়েছিল সেই তথ্য।

বাংলা ফোক ফ্যান্টাসি ছবির কাণ্ডারি ইবনে মিজানের সহকারী দেওয়ান নজরুল নিজের পরিচালিত ছবির কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ব্যক্তিগত ভাবে ইবনে মিজান ও দেওয়ান নজরুল হলেন মামাতো-ফুফাতো ভাই। দেওয়ান নজরুল ‘কাশবন চলছবি’ নামে নিজে একটি প্রযোজনা সংস্থা খুলেন । তাঁর সেই প্রযোজনা সংস্থা থেকেই প্রথম পরিচালিত ছবিটি নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। দেওয়ান নজরুল চেয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন কিছু করার, তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন হলিউডের ওয়েস্টার্ন প্যাটার্নের ছবি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যুক্ত করার। কারন ওয়েস্টার্ন প্যাটার্নের ছবি তখনও শুধু বাংলাদেশে নয়, উপমহাদেশেও কেউ নির্মাণ করেনি। দেওয়ান নজরুল সেই চিন্তাধারা থেকে বিদেশি কোন চলচ্চিত্র থেকে ধার করা গল্প না নিয়ে নিজেই একটি গল্প ও চিত্রনাট্য তৈরি করলেন যার নাম দিলেন ‘আসামী হাজির’। এখানে উল্লেখ্য যে দেওয়ান নজরুলের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘দোস্ত দুশমন’ হলেও তিনি প্রথম কাজে হাত দিয়েছিলেন ‘আসামী হাজির’ ছবিটির যার কাজ তিনি পরবর্তীতে শেষ করতে না পারায় বা মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেলে তখন ‘দোস্ত দুশমন’ ছবিটি মুক্তি পায় যা বক্স অফিসে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

ইবনে মিজানের সহকারী হিসেবে কাজ করার সময়েই সেই সময়কার জনপ্রিয় তারকা ওয়াসিম, সোহেল রানা, জসিম এর সাথে দেওয়ান নজরুলের সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নিজে যখন ছবি পরিচালনা করতে এলেন তখন ওয়াসিম সোহেল রানা জসিম কে মাথায় রেখেই ছবির গল্প তৈরি করলেন। ‘আসামী হাজির’ ছবির সহকারী প্রযোজক ছিলেন প্রয়াত প্রযোজক তাহের চৌধুরীর ছোট ভাই পণ্ডিত। শুরুতে ওয়াসিম সোহেল রানা জসিমের সাথে অলিভিয়া ছিলেন যিনি পরবর্তীতে বাদ পড়েন এবং তাঁর জায়গায় ববিতা যুক্ত হোন। মনসুর আহমেদের সুরে ও সাবিনা ইয়াসমিন –খুরশিদ আলমের কণ্ঠের ‘প্রেম নগরের প্রেমিক আমি ‘ গানটি রেকর্ডিং এর মধ্য দিয়ে দেওয়ান নজরুল তাঁর গুরু ইবনে মিজানকে দিয়ে ছবির মহরত উদ্বোধন করান।

বিশেষ কোন এক কারনে ছবিটি মহরতের পর কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং দেওয়ান নজরুল ‘দোস্ত দুশমন’ ছবিটির কাজ শুরু করেন। ‘দোস্ত দুশমন’ ছবির ব্যাপক সাফল্যর পর পরিচালক দেওয়ান নজরুল নিজেকে মাল্টিস্টার ও নিউ ডায়মেনশন পরিচালক হিসেবে প্রমাণ করার জন্য ‘আসামী হাজির‘ ছবির পুনরায় নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এই সময় প্রযোজক হিসেবে এগিয়ে আসেন ‘চিত্রদূত’এর কর্ণধার প্রয়াত বশিরুল হক। সঙ্গীত পরিচালক মনসুর আহমেদ এর জায়গায় আলম খান ও অলিভিয়ার জায়গায় ত্রিমাত্রিক চরিত্রের জন্য ববিতা’কে যুক্ত করে বাকি শিল্পীদের অপরিবর্তিত রাখা হয়।

যেহেতু ওয়েস্টার্ন প্যাটার্নের ছবি সেহেতু ছবির অভিনেতা অভিনেত্রিদের পোশাক, সেট, চলাফেরা, গানের ধরন সবকিছুতেই বৈচিত্র্য আনা হয়। ছবিতে ওয়াসিম জগনু-মগনু ও ববিতা হাসু–রাসু দুজনেই দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেন। সোহেল রানা ছিলেন পুলিশ অফিসার আর জসিম হলেন ডাকু সর্দার ধর্মা। এই ছবির চিত্রগ্রহনের জন্য কিছু আলাদা এফেক্ট ব্যবহার করা হয়। সাধারন বা নরমাল আই লেবেল লেন্স এর জায়গায় ৫০-এর লেন্স ব্যবহার করা হয় এবং ওয়েস্টার্ন অ্যাঙ্গেল অধিকাংশ চিত্র ধারন করা হয়। ক্যামেরা ও সাউন্ডে রিভার্স ফরওয়ার্ড টেনে দৃশ্যগুলো ধারন করা হয়। দ্বৈত চরিত্রের একসাথের দৃশ্য ধারনের সময় ক্যামেরায় ‘মাসকিং’ করা হয়। উল্লেখ্য যে নতুন করে ‘আসামি হাজির’ ছবির কাজ শুরু করার মহরতের অনুষ্ঠানে দেওয়ান নজরুলের সাথে তাঁর স্ত্রী শাহিন হোসেনের প্রথম পরিচয় হয়েছিল যেখান থেকেই পরবর্তীতে দুজনের সম্পর্ক তৈরি হয় যা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়।

Asami Hajir

ছবিতে ওয়াসিমের জগনু চরিত্রটি ছিল দুর্ধর্ষ ডাকাত ও মগনু চরিত্রটি ছিল হাবাগোবা কমেডি চরিত্রের যারা ছবিতে যমজ দুই ভাই এবং ববিতার রাসু চরিত্রটি ছিল পুলিশ অফিসার সোহেল রানা’র স্ত্রী ও হাসু ছিল মগনু’র প্রেমিকা চরিত্রে যারা যমজ দুই বোন। ডাকাত জগনুকে পুলিশে খুঁজছে আর হাবাগোবা মগনু শহরে আসে হারানো প্রেমিকার খোঁজে। ছোট বেলায় দুই ভাইয়ের বিচ্ছেদ ঘটেছিল এবং দুজন আলাদা আলদা পরিবেশে বড় হয়। আগেই বলেছি যে এই ছবিটি ছিল ওয়েস্টার্ন প্যাটার্নের সেই কারনে সেট ডিজাইনও করা হয়েছিল ওয়েস্টার্ন শহরের আদলে যা এফডিসির ৪ নং ফ্লোরে নির্মাণ করা হয়। এই ছবির কাহিনী ও চিত্রনাট্য এতোটাই জটিল ছিল যে দর্শক একটিবারের জন্যও পর্দার সামনে থেকে সরে যায়নি যা দেওয়ান নজরুলের বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। চিত্রনাট্য কি রকম জটিল ছিল তার দুটি উদাহরন দেই যা হলো ছবিতে সোহেল রানা’র স্ত্রী রাসু (ববিতা) সোহেল রানার সাথে বেড়াতে যায় যেখানে ডাকু ধর্মা (জসিম) সদলবলে হামলা চালায়। ববিতা পাহাড় থেকে পরে হারিয়ে যায় কিন্তু পরিচালক ববিতাকে কোন দৃশ্য মৃত না দেখিয়েই হাসু (ববিতা) চরিত্রটি দিয়ে দর্শকদের মনে বিশ্বাস করান যে ববিতা মারা গেছে। হাসুকে রাসুকে ভেবে সোহেল রানা ভালোবেসে ফেলে আর হাসুও সোহেল রানার বাড়ীতে আশ্রয় পেয়ে নিজেকে নিরাপদ রাখে। অন্যদিকে পুলিশ ভুল করে হাবাগোবা মগনুকে জগনুকে গ্রেফতার করে কিন্তু যখন দুইভাই একজন আরেকজনকে বাঁচাতে নিজেকে জগনু বলে দাবি করে তখন বিপাকে পরে যায়। …এরকম অনেক দন্ধমুখর ও টান টান উত্তেজনা ভরপুর ছিল পুরো ছবিটা।

এই ছবির শুটিং চলাকালিন কয়েকটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে যার একটি হলো কমলাপুর স্টেশনে ডাকাত জগনু (ওয়াসিম) সদলবলে রাতের আধারে কয়েকটি ওয়াগন লুট করবে যেখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে পুলিশ অফিসার সোহেল রানা ও তাঁর দল। গভীর রাতে শুটিং শুরু হয় যা শেষ হতে হতে সকাল হয়ে যায়। সারারাত একটানা শুটিং করতে করতে সবাই ক্লান্ত। সকাল হতেই সবাই দেখে সবার গায়ে মানুষের পায়খানা লেগে আছে। রাতভোর শুটিংয়ে সবাই এতোটাই আন্তরিক ছিল যে কেউ নিজেদের গায়ে লাগা পায়খানার দুর্গন্ধটিও টের পায়নি।

আরেকটি দৃশ্য ছিল সাভারে যেখানে ডাকাত ওয়াসিমের দলকে জসিমের লোকজন পথে বাঁধা দেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। দুই পক্ষের তুমুল সংঘর্ষ বেঁধে যায়। দৃশ্যটি চিত্রায়নের আগে কিছু ছোড়রা বোমা ফিট করাছিল যে পথ দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে ওয়াসিমের বাহিনী যাবে। ওয়াসিমের ঘোড়া বোমা পার হওয়ার আগেই বোমাটি ফেটে যায় অসাবধানতা বশত। ঘোড়া ভয় পেয়ে পাগলের মতো লাফাতে থাকে এবং একপর্যায়ে ওয়াসিমকে ১৫ ফুট দূরে ছিটকে ফেলে। ওয়াসিম ঘোড়ার উপর থেকে পড়ে মারাত্মক আহত হন। সবাই ভেবেছিল ওয়াসিম হয়তো মারা গেছেন। দ্রুত ওয়াসিম’কে সাভার ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালের মেজর জেনারেল সামাদ সাহেবের আন্তরিকতায় ওয়াসিম সেই যাত্রায় বেঁচে যান এবং ধিরে ধিরে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেন ।

এভাবে অনেক আন্তরিকতা, মেধা ও সাহসের সাথে নির্মিত হয়েছিল দেওয়ান নজরুলের ‘আসামি হাজির’ ছবিটি। কলাকুশলীদের এই আন্তিরকতা, শ্রমের বিনিময়ে সেদিন বাংলাদেশের সিনেমা দর্শক’রা দেখেছিল বিশ্বমানের একটি ওয়েস্টার্ন ছবি যা মুক্তি পাওয়ার প্রথম দিনেই বিপুল সাড়া ফেলেছিল। মুক্তির পাওয়ার প্রথম দিন গুলিস্থান সিনেমা হলে ছবিটির ব্যানার দেখেই হাজার হাজার দর্শকের ভিড় করে। একসময় দর্শক হলের কলাপসিবল গেইট ভেঙ্গে ফেলে ভেতরে প্রবেশ করে। শুধু ঢাকার গুলিস্থান সিনেমায় নয় এমন ঘটনা তখন দেশের বিভিন্ন সিনেমা হলে ঘটেছিল ছবিটি দেখার জন্য। এভাবেই কলাকুশলীদের মেধা, শ্রম ও আন্তরিকতায় এবং দর্শকদের ভালবাসায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে দেওয়ান নজরুল পরিচালিত ‘আসামি হাজির’ ছবিটি নিউ ডায়মেনশন সৃষ্টি করেছিল।

(তথ্য সুত্রঃ চলচ্চিত্র নির্মাণের নেপথ্য কথকতা। সহযোগিতায় ও কৃতজ্ঞতায়ঃ জুবায়েদ দীপ )
ফজলে এলাহী (কবি ও কাব্য)
১৫/০৮/১৫


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

কবি ও কাব্য

আমি ফজলে এলাহী পাপ্পু, কবি ও কাব্য নামে লিখি। স্বর্ণযুগের বাংলাদেশী চলচ্চিত্র এবং বাংলা গানকে এ যুগের সকলের কাছে পৌছে দেয়ার আগ্রহে লিখি।

মন্তব্য করুন