Select Page

মুখোশের আড়ালে মুখ ও মুখোশ

মুখোশের আড়ালে মুখ ও মুখোশ

aGwL82Zসাদৃশ্য বিবেচনায়, যে কোন সিনেমাই মুখোশধারী মুখ। এর আড়ালে থাকে শত বঞ্চনা, কষ্ট, পরিশ্রম, সম্মিলিত প্রচেষ্টা, উদ্যোগ, মমতার মত বিভিন্নমুখী বিশেষণ। ‘মুখ ও মুখোশ‘ চলচ্চিত্রটি যদি মুখোশ হয়, তবে এর আড়ালেও রয়েছে একটি মুখ যা সবসময় তার মুখোশের আড়ালেই থেকে যায়। মুখ ও মুখোশ চলচ্চিত্রের মুখোশের আড়ালে রয়েছে নানা রকম ঘাত-প্রতিঘাত, সহযোগিতা-বঞ্চনা, ভালোবাসা-দৃঢ়তার ছাপ। এই সব কিছুই একটি ইতিহাস তৈরীতে সাহায্য করেছে – অনেকগুলো মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল এই অঞ্চলে। ৫৬ বছর পরে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মানের ইতিহাসকে রূপকথা বলে ভ্রম হতে পারে। জেনে নেয়া যাক রূপকথার ন্যায় সেই ইতিহাস।

মুখ ও মুখোশ চলচ্চিত্রের জন্য সবার প্রথমে যে মানুষটির অবদানের কথা কৃতজ্ঞচিত্রে স্মরণ করতে হবে তিনি আবদুল জব্বার খান, মুখ ও মুখোশ চলচ্চিত্রের পরিচালক। ১৯৪৭ এ দেশ ভাগের পর দেখা গেল মুসলমানরা বাদে বেশীরভাগ কবি সাহিত্যিক কোলকাতায় রয়ে গেছেন। ফলে শিল্প সাহিত্যে পশ্চাতপদ হয়ৈ না থঅকার শপথে ঢাকাকেন্দ্রিক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রম শুরু হয়। তৎকালীন সময়ৈ যে সকল নাট্যনির্দেশক মঞ্চে নাটক নিয়ে উপস্থিত হতেন আবদুল জব্বার খান ছিলেন তাদের অন্যতম।

চলচ্চিত্র নির্মান করবেন এমন কোন চিন্তা আবদুল জব্বার খানের ছিল না – বরং অনেকটা জেদের বশে ১৯৫৩ সালে তিনি ঘোষনা দিয়ে বসেন – পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম চলচ্চিত্রটি তিনি বানিয়ে দেখাবেন। সে সময়ে সারাদেশে সিনেমাহলের সংখ্যা ছিল প্রায় ৯৩টি এবং এ সকল প্রেক্ষাগৃহে হিন্দী, উর্দু ও কোলকাতার বাংলা ছবি প্রদর্শিত হত। চলচ্চিত্র প্রযোজনা, পরিবেশনা, পরিদর্শন, স্টুডিও তথা সম্পূর্ন চলচ্চিত্র ব্যবসার সাথে জড়িত একজন ব্যবসায়ী, গুলিস্তান সিনেমার মালিক, দোসানী বলেছিলেন, এদেশের আদ্র আবহাওয়া চলচ্চিত্র নির্মানের পক্ষে উপযোগী নয়, বরং এ আবহাওয়ায় শ্যুটিং করতে হলে বিশেষ ধরনের নেগেটিভ তৈরী করতে হবে যা এদেশে কখনোই সম্ভব নয়। দোসানী সাহেব এ কথা বলেছিলেন পূর্ববঙ্গ সরকারের পরিসংখ্যান বিভাগের পরিচালক ডঃ আবদুস সাদেকের ব্যক্তিগত উদ্যোগে আয়োজিত স্থানীয়ভাবে চলচ্চিত্র নির্মান ও চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে তোলা সংক্রান্ত মতবিনিময় সভায়। উক্ত সভায় অন্যান্য প্রায় জনা চল্লিশেক নাট্য ও সংস্কৃতিকর্মী, স্থানীয় প্রদর্শক ও পরিবেশকদের মধ্যে আবদুল জব্বার খানও উপস্থিত ছিলেন এবং দোসানীর বক্তব্যের প্রতিবাদেই তিনি চলচ্চিত্র নির্মানের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন।

আবদুল জব্বার খানের এই চ্যালেঞ্জ হয়তো শুধু চ্যালেঞ্জই থেকে যেত যদি না ডঃ সাদেকের বন্ধু সারোয়ার সাহেব এ ব্যাপারে অনুপ্রাণিত না করতেন। চ্যালেঞ্জ দেয়ার প্রায় সাত মাস পরে আবদুল জব্বার খানের নাটক ‘ডাকাত’-এর রিহার্সেল চলাকালীন সময়ে তিনি এ উৎসাহ দিয়েছিলেন। প্রায় একই সময়ে দেশবিভাগের পূর্বে কোলকাতায় স্থাপিত ‘ইকবাল ফিল্মস’ পূর্ব পাকিস্তানে পুনর্গঠিত হয়। এর চেয়ারম্যান হন বলাকা সিনেমার মালিক এম এ হাসান, ম্যানেজিং ডিরেক্টর হন আবদুল জব্বার খানের সহকর্মী নুরুজ্জামান এবং আবদুল জব্বার খান হন পরিচালকদের একজন। এই ‘ইকবাল ফিল্মস’  এর পক্ষ থেকে আবদুল জব্বার খানের উপর চলচ্চিত্র নির্মানের পুরো দায়িত্ব পরে।

মুখ ও মুখোশ নির্মানের জন্য গল্প হিসেবে আবদুল জব্বার খান তার ‘ডাকাত’ নাটক সহ কবি জসিমউদদীন, কাজী নজরুল ইসলামের কিছু বইকে বেছে নেন। ডাকাত নাটকের পান্ডুলিপি নিয়ে কোলকাতায় যান তিনি, সাথে ছিলেন কিউ এম জামান যিনি মুখ ও মুখোশের চিত্রগ্রহন করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কোলকাতায় বিখ্যাত চিত্রনাট্যকার মণি বোসের সাথে দেখা করে চিত্রনাট্য লিখে দেয়ার অনুরোধ করেন তারা। শর্ত জুড়ে দেন, এমন কোন কাহিনী মনোনীত করতে হবে যাতে আউটডোরে কাজ করা যায় এবং কথা কম থাকে। মণি বোস সব যাচাই করে তার ‘ডাকাত’ নাটকের পান্ডুলিপিকেই চিত্রনাট্য হিসেবে প্রস্তুত করার পরামর্শ দেন এবং তিনটা দৃশ্য লিখে বাকিটা লাইন আপ করেন দিলেন। চিত্রনাট্যের বাকীটা নির্মাতা আবদুল জব্বার খান-ই তৈরী করে নেন।

চিত্রনাট্য প্রস্তুত করার চেয়েও বড় বাধা বিদ্যমান ছিল। বুঝতে হবে এটা এমন একটা সময় যখন পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র নির্মানের কোন ব্যবস্থাই নেই, কারিগরী সকল সহায়তার জন্যই পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের কোলকাতা অথবা আরও পাকিস্তানের অপর অংশ পশ্চিম পাকিস্তানের উপর নির্ভর করতে হতো। সিনেমা নির্মানের মত অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি প্রক্রিয়ায় কারিগরী সহায়তা যদি অন্য দেশ থেকে নিয়ে আসতে হয় তবে তা নির্মান ব্যয়কে আরও বাড়িয়েই দেয়। ফলে, মুখ ও মুখোশ নির্মানের আগেই আবদুল জব্বার খানকে এর কারিগরী দিকগুলো সম্পর্কে মনযোগ দিতে হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে সারোয়ার সাহেবের মালিকানাধীন একটি ৩৫ মি.মি. ক্যামেরা এবং সারোয়ার সাহেবকে ক্যামেরাম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হলেও পরবর্তীতে বাতিল করতে হয় কিউ এম জামানের মতামতের কারণে। কিউ এম জামান কোলকাতা এবং বোম্বেতে চিত্রগ্রাহকের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর দেশে ফিরেছেন। সারোয়ার সাহেবের ক্যামেরায় সিনেমা নির্মান সম্ভব না – জামানের এই মন্তব্যের পরে ক্যামেরা কেনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। মণি বোসের কাছ থেকে চিত্রনাট্য সম্পর্কে ধারনা নেয়ার উদ্দেশ্যে কোলকাতা গমনের সময়ই নিউ থিয়েটার্সের চিফ ক্যামেরাম্যান মুরারী মোহন ঘোষের সহযোগিতায় একটি পুরাতন আইমো ক্যামেরা কেনা হয়। একই সময়, মুরারী মোহনের সাথে চুক্তি হয় – ভারতীয় পাঁচ হাজার রূপীর বিনিময়ে মুখ ও মুখোশের চিত্রগ্রহণের কাজও তিনি করবেন। উল্লেখ্য, কিউ এম জামান কোলকাতায় মুরারী মোহনের দ্বিতীয় সহকারী হিসেবে কাজ করতেন।

মুখ ও মুখোশ নির্মানের জন্য গল্প নির্বাচন হল, চিত্রনাট্য তৈরী হল, ক্যামেরা কেনা হল, ক্যামেরাম্যানও ঠিক হল। এবার মাঠে নামার আগে শিল্পী বাছাই করতে হবে। শিল্পী বাছাইয়ের গল্প শোনার আগে মুখ ও মুখোশ চলচ্চিত্রের গল্প সম্পর্কে কিছু জেনে নেয়া যাক।

মুখ ও মুখোশ চলচ্চিত্রে এমন এক সময়ের গল্প বলা হয়েছে যখন সারা দেশ শমসের ডাকাতের অত্যাচার-নির্যাতনে বিপর্যস্ত। ডাকাতি, লুটতরাজ, খুন, নারী নির্যাতনসহ সব রকমের অন্যায়ে সিদ্ধহস্ত শমসের ডাকাত। এরকম সময়ে রহমান মৃধার প্রথম স্ত্রী একটি পুত্রসন্তান আফজাল-কে রেখে মারা যান, দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে দুটি সন্তান – পুত্র জালাল ও কন্যা রাশিদা। আফজালের যখন আট বছর বয়স তখন একদিন সৎ মার পিটুনি খেয়ে আফজাল অজ্ঞান হয়ে যায়, মরে গেছে ভেবে আফজালকে চুপিসারে কবর দিতে গেলে শমসের ডাকাতের হস্তগত হয় আফজাল। শমসের ডাকাতের ঘরে বড় হতে থাকে রহমান মৃধার পুত্র আফজাল।

আফজাল চরিত্রে কলিম শরাফী-কে অভিনয়ের প্রস্তাব নিয়ে চট্টগ্রামে যান আবদুল জব্বার খান ও তার দল। কিন্তু নায়ক চরিত্রের জন্য পারিশ্রমিক দেয়ার প্রস্তাব করে শরাফীর বন্ধুরা। অগত্যা, কলিম শরাফীকে কাস্ট করার চিন্তা বাদ দিতে হয়। কিন্তু চট্টগ্রামেই পাথরঘাটাস্থ মঞ্চঅভিনেত্রী পুর্ণিমা সেন গুপ্তার খবর পান জব্বার খান। পুর্ণিমার বাড়িতে গিয়ে ছবির নায়িকা চরিত্রের জন্য নির্বাচিত করেন পূর্ণিমাকে।

ঢাকায় ফেরার পর পত্রিকায় বিজ্ঞান দেয়া হয় অন্যান্য চরিত্রের জন্য অভিনেতা বাছাইয়ের জন্য। বিজ্ঞাপন দেখে গোপনে যোগাযোগ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়লের স্নাতক অধ্যয়নরত ছাত্রী জহরত আরা এবং ইডেন কলেজের আই.এ-র ছাত্রী পিয়ারী বেগম। ক্যামেরাম্যান মুরারী মোহন ঘোষ পিয়ারী বেগমকে দুজন প্রধাণ নায়িকার একজন হিসেবে নির্বাচন করেন। শমসের ডাকাত চরিত্রে নেয়া হয় ইনাম আহমদকে, আফজাল চরিত্রে আবদুল জব্বার খান নিজেই অভিনয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আরও অনেক চরিত্রের মধ্যে নূরুল আনাম খাঁ, গওহর জামিল, ভবেশ মুখার্জী, বিনয় বিশ্বাস, আউয়াল খান প্রমুখ নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসের মধ্যে মুখ ও মুখোশের জন্য অভিনেতা অভিনেত্রী নির্বাচনের কাজ শেষ হয়।

মুখ ও মুখোশে গান আছে মোট দুটি। আবদুল জব্বার খানর বন্ধু গীতিকার গফুর সাহেব বিনা পারিশ্রমিকে চারটি গান লিখে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু কাহিনীর প্রয়োজনে দুটি গানেই প্রয়োজন শেষ হয়। সমর দাস ও ধীর আলীকে সঙ্গীত পরিচালক ও সহকারী হিসেবে নেয়া হয়। কন্ঠ শিল্পী হিসেবে আবদুল আলীম ও মাহবুবা রহমানকে ঠিক করা হয়। সে সময় কোন রেকর্ডিং স্টুডিও বা গ্রামাফোন কোম্পানী গড়ে উঠেনি, ফলে গান রেকর্ড করা হয় টেপে। স্টুডিও ইকবাল ফিল্মস এর অফিস রুমে কাপড় টাঙ্গিয়ে তৈরী করা হয়েছিল!

এসব ১৯৫৩ সালের ঘটনা। ১৯৫৪ সালের ৬ আগষ্ট শাহবাগ হোটেলের ছাদে মুখ ও মুখোশ ছবির মহরৎ অনুষ্ঠিত হয়। মহরত উদ্বোধন করেন তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল ইসকান্দার মীর্জা। মহরতের পর শ্যুটিং শুরু হয়ে চলে ১৯৫৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। ১৯৫৩ সালের নভেম্বরে অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচন করার পর চিত্রগ্রহনের কাজ শেষ করতে করতে ১৯৫৫ সাল – মাঝের সময়টা নানা প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দৃর্যোগে পরিপূর্ণ। ছবির মহরত অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রায় আট মাস আগেই শ্যুটিং শুরু হয়েছিল – কোন প্রকার মহরত ছাড়াই। শুরুর এই চিত্রগ্রহনের দায়িত্বে ছিলেন কোলকাতার ক্যামেরাম্যান মুরারী মোহন ঘোষ। কিছুদিন চিত্রগ্রহন করার পর ডাকাত দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মোহাম্মদ হোসেন (বিচারপতি) শ্যুটিং এ আসা বন্ধ করে দেন। ফলে, চিত্রগ্রহন বন্ধ রাখতে হয় এবং চিত্রনাট্যে পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। তারও কিছুদিন পরে শুরু হয় ‘৫৪ সালের ভয়াবহ বন্যা, ফলে চিত্রগ্রহনের কাজ বন্ধ হয়ে যায় দীর্ঘ সময়ের জন্য। এই সময়ে চলচ্চিত্রের ফুটেজ লাহোরে শাহনূর স্টুডিওতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রিন্ট করার পর নানারকম ত্রুটি চিহ্নিত করা হয়। স্টুডিওর মালিক ও টেকনেশিয়ানরা  বিভিন্ন রকম পরামর্শ দেন ত্রুটিমুক্ত চিত্রগ্রহনের ব্যাপারে।

নতুন উদ্যমে শুরু করার জন্য আবদুল জব্বার খানরা দেশে ফিরে এলেও ফিরলেন না ক্যামেরাম্যান মুরারী মোহন। চলচ্চিত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই যখন হতাশ প্রায়, তখন একদিন পরিচালক জব্বার খান কিউ এম জামানকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন – চলচ্চিত্রের বাকী চিত্রগ্রহন সে করতে পারবে কিনা। কিউ এম জামানের প্রত্যয়দীপ্ত উত্তর নতুন প্রেরণা জোগায়। মহরতের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

মহরতের অনুষ্ঠানও দুর্যোগ কবলিত ছিল। জানা যায়, মুখ ও মুখোশের মহরত অনুষ্ঠানের আগে বিপুল বর্ষনে শাহবাগ এলাকায় হাটু পরিমান পানি জমে গিয়েছিল। গভর্ণর ইসকান্দার মীর্জা এর মধ্যেই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে শ্যুটিং শেষ হওয়ার আগে আরও একবার বন্যার কবলে পড়তে হয়েছিল মুখ ও মুখোশের টিমকে। বন্যা শেষে আবার চিত্রগ্রহনের কাজ শুরু করে শেষ করা হয়।

মুখ ও মুখোশের সম্পাদনার কাজ করা হয়েছিল লাহোরের শাহনূর স্টুডিও-তে। চিত্রগ্রহন করার সময়েই ছবির ফুটেজ পোস্টাল পার্সেলে করে শাহনূর স্টুডিওতে পাঠানো হয়, তারা প্রিন্ট করে ফলাফল জানিয়ে দিতেন। লাহোরে তিন মাস অবস্থান করে অভিজ্ঞ সম্পাদক লতিফ সাহেবের তত্ত্বাবধানে ছবির সম্পাদনা শেষ করেন। কিন্তু সম্পাদিত ছবির শব্দের অবস্থা ছিল করুণ। সম্পাদকের পরামর্শে জব্বার খান পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পীদের দিয়ে ডাবিং করানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু সফল হলেন না, কারণ শিল্পীরা বাংলা বলতে পারছিল না। পরে সম্পাদক অনেক সময় শব্দের প্রত্যেকটা অক্ষর ফ্রেম কেটে জোড়া দিয়ে সম্পাদনা শেষ করেন।

সম্পাদিত ফিল্ম পূর্ব পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও আবদুল জব্বার খানকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিচারপতি আবদুস সাত্তার (বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট) এর সহায়তা গ্রহণ করতে হয়েছিল। বিমানে ফিল্ম এবং স্বর্ণ পরিবহন করা যাবে না – এই খোড়া অজুহাতে বিমান থেকে ফিল্ম নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে আবদুল জব্বার খানসহ ফিল্ম পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।

মুখ ও মুখোশ নিয়ে ফিরে আসা গেলেও ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করা যাচ্ছিল না। হল মালিকরা ছবি চালাতে রাজি হচ্ছিলেন না, তাদের ধারনা ছিল ছবিটি ভালো হয় নি, দর্শকরা ছবি দেখে চেয়ার ভাংচুর করবে হয়তোবা। পাকিস্তান ফিল্ম ট্রাস্টের মোশাররফ হোসেন চৌধুরী এবং পাকিস্তান ফিল্ম সার্ভিসের আউয়াল সাহেবকে পরিবেশনের দায়িত্ব দেয়া হলে তারে নারায়নগঞ্জ সহ দুয়েকটি হল ঠিক করতে পারলেন। ঢাকার হলে মুক্তির জন্য মুকুল (বর্তমানে আজাদ) এবং রূপমহলের মালিক কমল বাবুর কাছে প্রস্তাব নিয়ে গেলে তিনি রাজী হয়ে গেলেন। ৩ আগষ্ট ১৯৫৬ তারিখ ঠিক হল। তৎকালীন গভর্ণর এ কে ফজলুল হক ছবির উদ্বোধন করলেন। মুকুল সিনেমা হলে বিকেল ৩টার শো-তে দেশের প্রথম চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ মুক্তি দেয়া হল।

মুখ ও মুখোশের নির্মান কথা যেন একটি রূপকথার গল্প। একদম শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন আবদুল জব্বার খানেরা। তারপর একটু একটু করে শত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে তৈরী করেছেন স্বপ্নের চলচ্চিত্র। রূপকথার গল্পের মতই মুখ ও মুখোশের নির্মান কাহিনীর শেষাংশ। মুক্তি দেয়ার পর টানা চার সপ্তাহ হাউজফুল চলেছিল ‘মুখ ও মুখোশ’। আরও চলতো – কিন্তু হলের বুকিং ছিল চার সপ্তাহের জন্য। তিন বছর বাদে ১৯৫৯ সালে মুক্তি পেল ‘আকাশ ও মাটি’, ‘মাটির পাহাড়’, ‘জাগো হুয়া সাভেরা’, ‘এদেশ তোমার আমার; ১৯৬০ সালে মুক্তি পেল  ‘রাজধানীর বুকে’ এবং ‘আসিয়া’। তারপর থেকে প্রত্যেক বছরেই মুক্তি পেয়েছে চলচ্চিত্র, চলছে এখনো। মুখ ও মুখোশের নির্মান ইতিহাস – সকল যুগেই এদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের অনুপ্রাণিত করেছে, করবে যতদিন বাংলাদেশী চলচ্চিত্র থাকবে।

(এই প্রবন্ধে সন্নিবেশিত সকল তথ্যই শরাফুল ইসলাম রচিত ‘মুখ ও মুখোশের ছেঁড়াপাতা’ এবং অনুপম হায়াৎ রচিত ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস’ বই থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে – লেখক)


মন্তব্য করুন