Select Page

মুভি রিভিউ: ছুঁয়ে দিলে মন

মুভি রিভিউ: ছুঁয়ে দিলে মন

chuye-dile-mon-movie-title-song-videoশিহাব শাহীন এইবার সিনেমা নির্মাণ করবেন। অপেক্ষা তখন থেকেই শুরু। এরপর সিনেমার মুক্তির তারিখ দেয়া হল ১৩ ই ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সেই সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে মুক্তির তারিখ আরো পিছিয়ে দিয়ে ১০ এপ্রিল নির্ধারণ করা হয়। অপেক্ষার প্রহর আরোও দীর্ঘায়ত হওয়ায় হতাশ হই। কিন্তু এই সময় সিনেমার টিম মুভির প্রচারণা পেছনে ব্যায় করে। এটা দেখে ভাল লাগে। যাই হোক অবশেষে ১০ এপ্রিল চলে এলো। পরের দিন অর্থাৎ ১১ এপ্রিল সন্ধ্যার শো তে যমুনার ব্লকবাস্টার সিনেমাতে দেখে ফেললাম বহুল প্রতিক্ষীত প্রিয় পরিচালক শিহাব শাহীনের প্রথম চলচ্চিত্র “ছুঁয়ে দিলে মন”।

বলার অপেক্ষা রাখে না “ছুঁয়ে দিলে মন” একটি রোমান্টিক ঘরনার সিনেমা। সিনেমার পরিচালক শিহাব শাহীন ভালবাসার গল্প ফুটিয়ে তুলতে কতটুকু পটু এর পরিচয় তিনি ছোট পর্দায় অনেকবার দিয়েছেন। এইবার প্রথম বারের জন্য নির্মাণ করেছেন বড় প‍র্দারর জন্য। আর এইবারও তিনি তার চৌকশতার ছাপ রেখেছেন তার সিনেমায়। সিনেমার গল্প, সংলাপ, গান, কাস্টিং থেকে শুরু করে লোকেশন নির্বাচন করা পর্যন্ত সকল স্তরেই তার নির্মাণশৈলীতে যত্নের ছাপ ছিল লক্ষ করার মত।

কুশীলব :
আরেফিন শুভ (আবির)
জাকিয়া বারী মম (নীলা)
ইরেশ জাকের ( ড্যানী)
মিশা সওদাগর (আবিরের দুলাভাই)
আলী রাজ (নীলার বাবা)
আনন্দ খালেদ (মটু/পাভেল)
সুষমা সরকার ( আবিরের বোন)
[ সুষমা সরকার কে নিয়ে একটু বলতে চাই। একাত্তর টিভি তে সিনেমা জার্নাল ভিত্তিক একটা প্রামাণ্য শো হত “বিনোদন কারখানা”। ওই শো এর উপস্থাপক সুষমা নিজেকে অসাধারণ ভাবে বিভিন্ন মুভির চরিত্রে নিজেকে উপস্থাপন করত। আমি ওই শো দেখলেই মনে হত এই মেয়ে সিনেমা তে কেন নাম লিখায় না। অবশেষে সিনেমার পর্দায় তাকে দেখলাম এই সিনেমার মাধ্যমে। ]

কাহিনী সংক্ষেপ :
গ্রামের নাম হৃদয়পুর। গ্রামের এক দুরন্ত ছেলে আবির। গ্রামের এক বড় ভাইয়ের সাথে তার প্রেমিকার সাথে দেখা করতে সাহায্য করে আবির। ওই ভাইয়ের প্রেমিকা একদিন তার সাথে দেখা করতে আসার সময় তার সাথে তার এক খালাতো বোনকে নিয়ে আসে। মেয়েটির নাম নীলা। নীলা কে ভাললেগে যায় আবিরের। আবির কেও ভাল লাগতে শুরু করে নীলার। মাঝখানে অনেকগুলো ঘটনা-দূর্ঘটনা ঘটে যায়। পরিবার সহ গ্রাম ছাড়তে হয় আবিরদের। এরই মধ্যে কেটে গেছে ১২ টি বছর। আবির অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। তাদের নিজস্ব একটি ব্যান্ড দল আছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের ব্যান্ড এর ডাক আসে গান করার জন্য। এমনি ভাবে একদিন হৃদয়পুরের এক কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে গানের আমন্ত্রণ পায় আবিরের ব্যান্ড দল। কিন্তু ১২ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা মনে করে এই অনুষ্ঠনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানায় আবির। কিন্তু নিয়তি তো আর বদলানো যায় না। ছলনাময়ী নিয়তির নিখুত ছলনায় আবির গিয়ে পৌঁছে সেই হৃদয়পুরেই……..। শুরু হয় ভালবাসা নতুন উপাখ্যান। কিন্তু সেই ১২ বছর আগের স্মৃতি?

গান :
“মনপুরা”, “জাগো”, “থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার”, “চোরাবালি” এর পর এইবার “ছুঁয়ে দিলে মন “। যে মুভিগুলোর নাম লিখলাম এই মুভিগুলোর সব গুলো গান ই ভাল লেগেছে। ছুঁয়ে দিলে মন মুভিতে একটি ফিউশন সহ মোট গান ৭ টি।
শাকিলা সাকি আর তাহসানের কন্ঠে টাইটেল ট্র্যাক, কনা-ইমরানের “শূন্য থেকে আসে প্রেম”, নির্ঝর এর “ছুঁয়ে দিলাম”, শাওয়নের “চিনিনা” আর শকিলা সাকির সাথে “চলে যও তুমি” এবং হাবীবের কন্ঠে “ভালবাসা দাও, ভালবাসা নাও”। প্রত্যেকটি গানই হয়েছে অসাধারণ। তবে আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে “চিনিনা” ও “ভালবাসা দাও, ভালবাসা নাও”। তৃতীয় পছন্দ “ছুঁয়ে দিলাম” আর “চলে যাও তুমি” শিরনামের গান দুটি [যৌথ ভাবে :পি ]। আর এই মুভির কোন গান হিসেবে প্রথম শুনেছিলাম তাহসানের কণ্ঠে “তুমি ছুঁয়ে দিলে মন” গানটি।
মুভির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও ছিল অত্যন্ত সামাঞ্জস্যপূন্য এবং শ্রুতিমধুর। এক কথায় বলতে গেলে পুরা মিউজিক পার্ট টা ই হয়েছে অসাধারণ।

পজেটিভ মূল্যায়ন :
প্রথমেই পজেটিভ যে বিষয়টি শুরু করতে চাই তা হল আমার এক্সপেকটেশনের কতটুকু পূরণ করেছে “ছুঁয়ে দিলে মন”। সত্যি বলতে ছুঁয়ে দিলে মন মুভি নিয়ে যতটুকু এক্সপেকটেশন নিয়ে গিয়েছিলাম, ছুঁয়ে দিলে মন তার চেয়ে অনেক বেশীই মন ছুঁয়ে দিয়েছে। শুধু আমার না। সবার মন ছুঁয়ে দেয়ার মতই একটা সিনেমা নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন। এক কথায় বলতে গেলে সুন্দর গল্পের সুনির্মিত একটি সিনেমা। সিনেমায় যেমন কারও অভিনয়ে অতি অভিনয়তা দেখা যায় নি, তেমনি কারও ডায়লগেও ছিল না বাস্তবতা বিবর্জিত কোন বাক্য। সুন্দর লোকেশনের পাশাপাশি কাস্টদের পোশাক পরিচ্ছদও ছিল চমকপ্রদ। পরিচালকের গল্প বলার ভঙ্গি ছিল খুবই সাবলীল। অবশ্য এখানে ক্রেডিট পুরোটা পরিচালকের পাল্লায় দেয়া যাবে না। কিছু ক্রেডিট সু অভিনেতা আরেফিন শুভ এবং ন্যাচারাল অ্যাকট্রেস জাকিয়া বারি মম’রও রয়েছে। শুধু এই সিনেমার কুশীলবদের অভিনয়ের প্রশংশা করেই আরেক টি রিভিউ লেখা সম্ভব। জাকিয়া বারি মম সম্পর্কে নতুন ভাবে বলার কিছু নেই। প্রথমবার “দারুচিনি দ্বীপ” মুভিতে তাকে আমি দেখেছিলাম। সত্যি বলতে তখন থেকেই তাকে আমার ভাল লাগে। তাকে ভাল লাগে বলতে তার অভিনয় আমার ভাল লাগে। অতি সাধারন সাদাসিদে মেয়ে মম এইবার নিজের চরিত্রকে ভেঙে নতুন ভাবে হাজির হয়েছেন শিহাব শাহীনের হাত ধরে। এইবারও তিনি উৎরে গেছেন খুব ভাল ভাবেই।
আর আরেফিন শুভ’র কথা তো সবারই জানা। খুব অল্পদিনেই তিনি তার নিজের দক্ষতা প্রমাণ রেখেছেন আমাদের সিনেমা মহলে। এর আগে যে কয়টি বাণিজ্যিক ধারার সিনেমায় অভিনয় করেছেন, সবগুলোই ছিল অ্যাকশনধর্মী। এইবার বড় পর্দার দর্শক রা তাকে পাবেন একেবারে রোমান্টিক নায়কের চরিত্রে। অনেকে তাদের রিভিউ তে লিখেছেন যে, তাদের সন্দেহ ছিল যে রোমান্টিক নায়কের চরত্রে শুভ ভাল করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে। আমি এমন রিভিউ দেখে হেসেছি। কারন আরেফিন শুভ কে আমি ছোট পর্দায় রোমান্টিক নায়কের চরিত্রেই সবচেয়ে বেশী দেখেছি। এই সিনেমাতেও তিনি আনবিটেন।
আর ভিলেন চরিত্রে অনন্যসাধারণ অভিনয় করেছেন ইরেশ জাকের। প্রথম দিকে তাকে খুবই ইনোসেন্ট মনে হয়। পর্দায় তার উপস্থিতি দর্শক দের হাসির খোরাক যোগায়। কিন্তু শেষ অংশে তাকে বাংলা সিনেমার ট্রিপিক্যাল ভিলেনের চেয়ে কোন অংশে কম মনে হয় নি।
কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোর সাথে বলা যায় পাল্লা দিয়েই অভিনয় করেছে পার্শ্ব চরত্রের অভিনয় শিল্পী রা। সুষমা সরকারের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। সুষমার স্বামীর চরিত্রে মিশা সওদাগরও ছিলেন অসাধারণ। পজেটিভ চরিত্রেও যে মিশা সওদাগর, মিশা সওদাগর ই তা এই মুভিতে তিনি প্রমাণ রেখেছেন। আর যে চরত্রটির কথা না বললেই নয় তা হল মুভিতে শুভ’র বন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করা মটু অথাবা পাভেল তথা আনন্দ খালেদ। সিনেমার হাস্যরসাত্নক অংশগুলোর ৮০% ই এসেছে তার মাধ্যমে। উল্লেখ্য জোড় করে হাসানোর চেষ্টা করানো হয়নি। হাসির দৃশ্য গুলো এতটাই নিখুত হয়েছে যে হাসি নিজে থেকেই এসে যাবে।
লোকেশন, কোরিওগ্রাফি, ক্যামেরা ওয়ার্ক এর জন্য শিহাব শাহীনের “ছুঁয়ে দিলে মন” ৫/৫ এর দাবী করতেই পারে।

নেগেটিভ দিক :
এই সিনেমায় আমি নেগেটিভলি উল্লেখ করার মত কিছু তেমন পাই নি। তবে দু একটি বিষয় যেমন মম’র ড্রেস আপ কখনো কখনো বাজে মনে হয়েছে। মম’র পোশাক নিয়ে পরিচালক আরেকটু যত্নশীল হতে পারতেন। তবে যে বিষয়টি সত্যিই খারাপ লেগেছে তা হল মম’র মুখের গাঢ় মেক আপ। মম’র মুখের গঢ় মেক আপে কখনো কখনো সিকুয়েন্স গুলো মেকি মনে হয়ছে।

সার্বিক মূল্যায়ন :
আমি “ছুঁয়ে দিলে মন” দেখে আসার পর আমার অনেক গুলো বন্ধু কে মুভিটি দেখার জন্য সাজেস্ট করেছিলাম। পরদিন ই এক বন্ধু মুভিটি দেখে এসে জানায় সে দেখেছে তার ভাল লেগেছে। আমি তাকে বলেছিলাম,এই মুভির ৫ টা পজেটিভ দিক আর ৫ টা নেগেটিভ দিক বলতে। ওর পয়েন্ট গুলো ছিল এমন –
“পজেটিভ দিক :
১. মুভির ভিডিও কোয়ালিটি খুব ভাল।
২.মুভির লোকেশন গুলা সুন্দর।
৩.সব গুলা গান ই জোশ।
৪.সবার অভিনয় ই ভাল ছিল।
৫.কাস্ট সিলেকশন পারফেক্ট হইছে।
নেগেটিভ দিক :
১.আরেফিন শুভর মাংকি পাঞ্চ।
২.মমকে মেডিকেল স্টুডেন্ট বানানো। (কারন মেডিকেল স্টুডেন্ট রা সাদাসিধা থাকে। কারন তারা মেক আপেরও সময় পায় না)
৩.নাই
৪.নাই
৫.নাই ”
নিজের সাথে এইবার আরেকজনের মত মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলাম। দেখলাম হুম..আমার অব্জারভেশন ক্ষমতা একেবারে যাচ্ছেতাই না। আর কিছু বলার নেই। শুধু এত টুকু বলব, বিশেষ কোন বিশেষণে যদি এই মুভিকে বিশেষায়িত করতে বলা হয়, তবে আমি বলব “ছুঁয়ে দিলে মন” সিনমাটি হল “বাংলাদেশের- দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে “।

পরিশিষ্ট :
লিখতে বসলে প্রতিবারই “ছুঁয়ে দিলে মন” মুভি নিয়ে নতুন নতুন প্রশংসা ভরা কাব্য লেখা সম্ভব। কিন্তু এই কাব্য /উপন্যাস কেবল তখন ই সার্থক হবে যখন প্রেক্ষগৃহে গিয়ে সিনেমাটি দেখবে সবাই। জানি না “ছুঁয়ে দিলে মন” সিনেমাটি “মনপুরা”র মত নতুন কোন রেকর্ড গড়তে পারবে কিনা। অনেক অনেক শুভ কামনা রইল সিনেমাটির জন্য। আর শিহাব শাহীনের কাছে আবেদন থাকবে এমন সিনেমা আরও চাই, যে সিনেমা সত্যিই মন ছুঁয়ে যায়।
সবাইকে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে সিনেমাটি দেখার আমন্ত্রণ।

পুনশ্চ :
আমি ১১ তারিখ সন্ধ্যার শো তে যমুনা’র ব্লকবাস্টারে মুভিটি দেখেছি তা আগেই উল্লেখ করেছি। যা বলি নি কিন্তু লিখতে মনটা খুব উসখুস করছে, তা হল -মুভি দেখার সময় আমার ডান পাশের সিটে ষাটোর্ধ একটি দম্পতি সিনেমাটি দেখছিলেন। তারা সিনেমাটি যে খুব উপভোগ করছেন তা তাদের দেখে বুঝতে পারছিলাম।
ষাটোর্ধ এই দম্পতি মুভি দেখতে এসেছে, এটা দেখে কেন যেন আমার খুব ভাল লেগেছে। তাদের কে একবার বলতে চাইলাম যে আমি আপনাদের সাথে একটা পিক তুলতে চাই। একা ছিলাম, কি না কি ভাবে তাই আর বলার সাহস হয় নি।


মন্তব্য করুন