Select Page

হৃদয়ে আঁচড় কাটে অচেনা হৃদয়

হৃদয়ে আঁচড় কাটে অচেনা হৃদয়

unnamedপ্রতি বছর ঢালিউডে আসছে অসংখ্য নতুন মুখ। কিন্তু এত অচেনা মুখের মাঝে অল্প কিছু মুখই আমাদের হৃদয়ে আচঁড় কাটতে পারছে। ২২শে মে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র অচেনা হৃদয়ের কলাকুশলীদের সেই অল্প কিছুর কাতারে ফেলা যায়। নবীন পরিচালক এস.আই.খান’র অচেনা হৃদয়ের কেন্দ্রীয় তিন চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইমন, প্রসূন আজাদ ও নবাগত সুমন। ফিল্ম লাইফ প্রোডাকশনসের ব্যানারে নির্মিত হয়েছে অচেনা হৃদয়।

একই কলেজে পড়েন ইমন আর সুমন (সংলাপে কলেজ বলা হলেও, লোকেশনটা বারবর ঢাকা ভার্সিটিই ছিল)। সেই কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী প্রসূন। ইমন মেধামী ছাত্র, মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকাবারও সময় তার নেই। প্রসূন ইমনের কাছ থেকে ফার্স্ট ইয়ারের নোটস নিত। নোটস দিতে দিতে একসময় ইমন মনও দিয়ে ফেলেন। কিন্তু প্রসূনের জীবনে এর মাঝে এসে গিয়েছে অন্য একজন-এলাকার পরিচিত ব্যাডবয় সুমন। মাস্তান হলেও সুমনের নিজস্ব কিছু নীতি রয়েছে। সে ইভটিজারদের পিটায়, অচেনা কাউকে খুন করে না। সুমনের এই কোড অফ কন্ডাক্ট তার গডফাদার সুলতানের (টাইগার রবি) খুবই অপছন্দ। প্রসূনের কারণে অন্ধকার জীবন ছেড়ে আসতে চায় সুমন। কিন্তু সুমনের গডফাদার টাইগার রবির এতে বিন্দুমাত্র সায় নেই। এমন সময়ে প্রসূনের চোখের সামনে একটি খুনের ঘটনা ঘটে। শকের চোটে স্মৃতিশক্তি হারায় প্রসূন। আশ্রয় নেয় ইমনের বাসায়। আর সুলতান ভাই উঠে পড়ে লাগেন খুনের একমাত্র স্বাক্ষী প্রসূনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে। গল্প মোড় নেয় ভিন্ন দিকে।

অল্প কথায় এটাই ছিল রোম্যান্টিক থ্রিলার অচেনা হৃদয়ের গল্প। গল্প ও চিত্রনাট্য লিখেছেন পরিচালক নিজেই। গল্পটি মৌলিক হলেও সিনেমার নিয়মিত দর্শকদের কাছে স্বাভাবিকভাবেই এটা নতুন কোন গল্প নয়। ত্রিভুজ প্রেম, গ্যাংস্টারের ভালো হবার চেষ্টায় গডফাদারের বাধা এসব উপকরণ দিয়ে আগেও ছবি হয়েছে। যেখানে গিয়ে গল্পটা নিজেকে আলাদা করে নেয় তা হলো-পরিবেশনা। নায়িকা গুডবয়ের প্রেমে পড়বে আর ব্যাডবয় ভিলেন হয়ে তাদের জীবনে নরক করে দেবে, ত্রিভুজ প্রেমের গল্পের এই ট্র‌েডিশনাল আর্কিটাইপকে ভেঙেছেন এস.আই.খান। দুই উপকরণকে এক করে স্ক্রীপ্ট সাজিয়েছেন তিনি। কিন্তু তারপরও স্ক্রীপ্টটা একটু স্লো। সিকোয়েন্স নিয়মিত পাল্টালেও, গল্প বেশ কিছু সময় একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধে স্ক্রীপ্ট অনেকটাই গতি হারায়।

তবে পরিচালক হিসেবে এস.আই.খান অনেক বেশি মার্কস পাবেন। ডিরেকশন অনেক গোছানো ছিল। পুরো ছবিতে একটিবারের জন্যও মনে হয়নি ডেব্যুট্যান্ট কোন পরিচালকের কাজ দেখছি। সবার কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিয়েছেন। বাজেট স্বল্পতা থাকলেও লোকেশনগুলো খুব স্মার্টলি ব্যবহার করেছেন। সিনেম্যাটোগ্রাফিও ভালো ছিল। চিত্রগ্রাহকত্রয়ীর কাজ ভালো হয়েছে। ভালো অ্যাঙ্গেল ও মুভমেন্টের কারণে চেনা জায়গাগুলোতেও নতুনত্ব এসেছে। একটি দৃশ্যের কথা বলি, প্রসূন আর তার বান্ধবী রাস্তা পার হয়ে আসলেন, ডায়লগ শেষ করলেন তার পরে অন্য এক পাশ থেকে ইমনের বন্ধু এসে তার সংলাপটা বললেন। পুরো শটটি একটি লং টেকে নেয়া। কমার্শিয়াল মুভিতে একটা দৃশ্যের জন্য কেউ এতটা এফোর্ট দেয় না।

অভিনেতাদের প্রায় সবাই নতুন। প্রসূনের সর্বনাশা ইয়াবা আগে মুক্তি পেলেও, এটিই তার প্রথম ছবি। রূপা চরিত্রে অভিনয় করার অনেক সুযোগ ছিল, প্রসূন সেটা কাজেও লাগিয়েছেন। প্রসূন মনে হয় তেমন একটা নাচ পারেন না। এই দিকে একটু মনযোগ দিলে ভালো। সুমনের ক্যারেক্টারে কাজ করার খুব একটা জায়গা ছিল না। তার এক্সপ্রেশনে কিছুটা ঘাটতি আছে। আশা করি সামনে সেটা পুষিয়ে নেবেন। ইমনকে আগের চে অনেক ম্যাচিওরড লেগেছে। সুমনের বন্ধু মিশু আর ইমনের বন্ধু রাহাতের অভিনয়ও ভালো লেগেছে। আলাদা করে বলতে হয় টাইগার রবির কথা। তাকে এর আগে অন্য একটি চলচ্চিত্রে দেখে ছিলাম। ডেলেভারি, জেশ্চার, চাউনি সব মিলিয়ে এই লোক খুবই ন্যাচারাল, একদম পারফেক্ট ভিলেন।

ছবির ছবির গান লিখেছেন ওয়াহিদ বাবু ও পিন্টু ঘোষ আর সুর করেছেন বেলাল খান ও পিন্টু ঘোষ। ছবিতে অনেকগুলো গান থাকলেও, পরিচালক সেগুলো সম্পূর্ন ব্যবহার না করে প্রয়োজন অনুযায়ী রেখেছিলেন। গানগুলো বেশ মেলোডিয়াস। বেলাল খান ও নওমী’র কন্ঠে “অচেনা ছিলে” গানটি সবচে ভালো লেগেছে। এই গানের কোরিওগ্রাফিও ভালো হয়েছে (অল্প করে “দিল সে” ছবির জিয়া জালে গানটির কথা মনে করিয়ে দিলেও, সেটাকে তেমন আমলে নিলাম না)। সর্বোপরি সব গানের কোরিওগ্রাফি ভালো হলেও, আইটেম গানে সাদিয়া আফরিনকে অনেক মেলো লেগেছে। ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ও এর ব্যবহার যথাযথ ছিল।

এই মুভিটা টেকনিক্যালি খুব সাউন্ড। ঝকঝকে প্রিন্ট, চোখ জুড়ানো (কিছু দৃশ্যে চোখ ঝলসানো) কালার গ্রেডিং। আর্ট ডিরেকশন, সেট ডিজাইন খুব ভালো ছিল। নওরিন জাহানের কস্টিউমেরও প্রশংসা করতে হয়। ছবির ওপেনিং ক্রেডিটস অনেক নান্দনিক ছিল। বেশ কিছু ব্যাপার পরিচালকের সেন্স অফ হিউমারের প্রমাণ। যেমন : ভিলেন জামানের ভেসপা অথবা সুলতানের টাকমাথার দুই বডিগার্ড। যাদের হঠাৎ করে দেখলে নায়ক রুবেল বলে ভ্রম হয়।  তবে, কমিক রিলিফের দিকে আরেকটু মনযোগ দিলে ভালো হত। একই কথা অ্যাকশন সিকোয়েন্সের ক্ষেত্রেও খাটে। সুমনের ফিজিকের সাথে মিল রেখে কিছু পিওর অ্যাকশন (ফিজিক্সের ভাষায় অবাস্তব অ্যাকশন) সিকোয়েন্স রাখা উচিৎ ছিল। মাসালটাইপ অ্যাকশন ছিল, কিন্তু সেগুলো চকলেট বয় ইমনকে দিয়ে করানোয় হাসিই পেয়েছে। প্রসূনের অসুখটা দেখলাম অনেকেই অ্যামনেশিয়ার সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন। তাই তার চরিত্রের পরিণতিটা অনেকেই ঠিক ঠাওর করতে পারেননি। দেশী সিনেমায় একদম সংলাপবিহীন ক্লাইম্যাক্স কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। একটু ডায়লগবাজি থাকলে মন্দ হতো না। কিছু দৃশ্যে দু-একটি সংলাপ একদমই শোনা যায়নি। এটা ডাবিং-এর সমস্যা নাকি হলের সাউন্ড সিস্টেমের সমস্যা সেটা বুঝলাম না।

এই মুভির সবচে বড় প্রাপ্তি নায়ক সুমন (রুদ্র)। তার অ্যাপিয়ারেন্স-ফ্যাশন সেন্স-ভয়েস সব মিলিয়ে একটা ম্যানলি ইমেজ আছে, যেটা এখনকার বেশিরভাগ নায়কদের মাঝে বিরল। যদিও তার অভিনয়টা এখনো তেমন ভালো না, কিন্তু অ্যাকশন হিরোদের অভিনয় জানা খুব একটা জরুরীও না। তাকে ঠিকমত পরিচর্যা করতে পারলে, আগামীতে দারুন এক অ্যাকশন হিরো পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস।


মন্তব্য করুন